প্রযুক্তির আঙিনায় ওদের পদচারণা

নারী শিক্ষার হার এখন পুরুষদের থেকে বেশি হলেও তারা ঐ হারে নানাবিধ

সমস্যার কারণে কর্মস্থলে যোগদান করছে না। সেসব নারীদের জন্য আইটি সম্ভাবনাময়

একটি সেক্টর, তারা ঘরে বসেই দক্ষতার সাথে আউটসোর্সিং-এর বিভিন্ন কাজ করতে

পারছে। যা তার নিজের জন্য এবং দেশের জন্যও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে

তুনাজ্জিনা রেমি

সেই কোমল হাত দু’টি এখন কেবল আর মেহেদী রাঙাতেই ব্যস্ত থাকে না। কেবলই সচল থাকে না চুল বাঁধতে অথবা ঘর সাজাতে। চুলার উপর রান্নার হাড়ির তাপে শক্ত হওয়া হাতগুলোর বিচরণ এখন সর্বত্র। কোমল হাতগুলো শক্ত হাতে চালিয়ে নিচ্ছে প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কাজ। মেঘের উপর দিয়ে ভেসে বেড়ানো বিমানের দিক নির্ণয় করতে, বলের আঘাতে স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিতে, দক্ষ হাতে কম্পিউটারের কিবোর্ড চেপে দুনিয়া জয় করতেও সরব থাকে নারীর হাত। এমন অনেক খাতে নারীর অগ্রযাত্রার পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান তথ্য-প্রযুক্তি খাতে নারীর বিচরণ হচ্ছে দ্রুত গতিতে।

তবে কিছুদিন আগেও প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের পরিমাণ ছিল পুরুষদের তুলনায় কম। বর্তমানে এ চিত্র অনেকখানি পাল্টে গেছে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ক প্রশিক্ষণে শতকরা ৩০ ভাগ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ নারীই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে তাদের ক্ষমতায়নে কাজে লাগাচ্ছে। ইন্টারনেট এমন একটি জায়গা যেখানে নারীরা কোন সামাজিক বাঁধা বা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার না হয়েই তাদের চিন্তা ভাবনা ও মতামত তুলে ধরতে পারছে। অনেক নারীই ঘরের বাইরে গিয়ে কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে না। ঘরে বসেই তারা বিভিন্ন পাবলিক জায়গাগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারে ইন্টারনেটের সাহায্যে। তাই উন্নয়ন কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণে যেসব বাধা রয়েছে, বিশেষ করে স্থান ও নিরাপত্তার ব্যাপারটি অনেকাংশেই কমিয়ে এনেছে প্রযুক্তি। বেশিরভাগ নারীই ইন্টারনেটকে বাধা অতিক্রমকারী এবং নিরবতা ভাঙার উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে এবং তাদের ভবিষ্যতের ক্ষমতায়নের জন্য একটি হাতিয়ার হয়ে উঠছে।

আইসিটি অকল্পনীয়কে সত্য করে দিয়ে নারীদের জন্য ব্যাপারটা অনেক সহজ করে দিয়েছে। জ্ঞান আদান-প্রদান ও উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে আইসিটি নারীর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া শুরু করে। বর্তমানে এদেশের নারীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গ্রাফিক্স ডিজাইন, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব পোর্টাল, কল সেন্টার, মোবাইল এপি­কেশন, সামাজিক যোগাযোগসহ নানা ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর পেশায় অংশগ্রহণ করে পুরুষদের থেকেও ভাল কর্মক্ষমতা দেখচ্ছে। কম্পিউটার কৌশল, কম্পিউটার বিজ্ঞান, টেলিযোগাযোগ প্রকৌশল, ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্সের মতো বিষয়গুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ঘরে বসেই আইসিটি খাতে একজন নারীর অংশগ্রহণ ভেঙে দিতে পারে নানা ধরনের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও প্রাচীন যুগ থেকে চলতে আসা ধ্যান ধারণা।

ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে নারী আজ একাই নিজের পরিচয় সৃষ্টি করতে পারছে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিকম অপারেটর এবং জেলা মহিলা ব্যবসায় ফোরাম একত্রিত হয়ে দেশব্যাপী নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এই পদক্ষেপের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে যোগাযোগ স্থাপন এবং জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও সেবা প্রদান করা। এর মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে তাদের কর্ম কৌশলকে আরো উন্নত করতে পারবে। এছাড়াও নিজেদের নিত্যনতুন ধারণাকে অন্যান্য নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারবে। কোন নারী যদি নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করতে চান তাহলে তিনি জেলা মহিলা ব্যবসা ফোরামের মাধ্যমে অন্যান্য নারী উদ্যোক্তাদের থেকে ঋণ সুবিধা, লাইসেন্স ইত্যাদি বিষয়ে উপদেশ নিতে পারবেন। এর মাধ্যমে নারীরা নিজেদের ভার্চুয়াল বাণিজ্য কেন্দ্রও গড়ে নিতে পারেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুককে কাজে লাগিয়ে নারীরা খুব সহজেই তাদের গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে পারছে। নিজস্ব ফেইসবুক পেজ খুলে নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যবসার প্রচার ও প্রসার করতে পারছে। তারা দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন পোশাক, কসমেটিক্স ও বিভিন্ন পণ্য এনে লাইভের মাধ্যমে গ্রাহকদের দেখিয়ে করছে কেনাবেচা। তাদের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হচ্ছে। আবার অনেকে নিজেই ইউটিউবের সাহায্যে তৈরি করছেন পছন্দমত হাতে তৈরি পণ্য ও বিক্রি করছেন অনলাইনে। অনলাইন সাংবাদিকতা, ফ্রিল্যান্সিং, ব্লগিং ইত্যাদি আউটসোর্সিং সুবিধাকেও তারা উপার্জনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে। নারীরা যে শুধু প্রযুক্তির সাহায্যে কাজ করছে তাই নয়, নারীরা প্রযুক্তি তৈরিতেও কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে দুটি পরমাণু শক্তি কমিশন রয়েছে যেখানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা সেমিকন্ডাক্টর আইসি, ভিএলএস আই ডিজাইন, ফেব্রিকেশন তৈরির কাজ করছেন। যে কোন প্রযুক্তির কাঠামোগত মূল হচ্ছে এই জিনিসগুলো। আমাদের দেশের আইসিটি মার্কেট ও এয়ারটেলের চিফ সার্ভিস অফিস হিসেবে কাজ করছেন রুবাবা দৌলা এবং ডেলের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে সোনিয়া বশির কবিরের মত নারীরাই পরিচালনা করছেন।

‘আইটি ক্রিয়েটিভ’ নামে একটি আইটি ফার্ম-এর সিইও মনির হোসেইন বলেন, আমাদের ফার্মে অনেক নারী কাজ করছে এবং তারা পুরুষদের থেকে ভালো দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে। কেন না নারীরা কাজের ক্ষেত্রে পুরুষদের থেকে অনেক বেশি মনোযোগী হয়ে থাকেন। নারী শিক্ষার হার এখন পুরুষদের থেকে বেশি হলেও তারা ঐ হারে নানাবিধ সমস্যার কারণে কর্মস্থলে যোগদান করছে না। সেসব নারীদের জন্য আইটি সম্ভাবনাময় একটি খাত, তারা ঘরে বসেই দক্ষতার সাথে আউটসোর্সিং-এর বিভিন্ন কাজ করতে পারছে। যা তার নিজের জন্য এবং দেশের জন্যও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এখানকার নির্বাহী পরিচালক পারভিন আক্তার শম্পা বলেন, ‘একজন মেয়ের যখন সংসার বা সন্তান হয়ে যাচ্ছে তখন সে চাইলেই যখন তখন বাইরে যেতে পারে না বিভিন্ন কারণে। এখন আমার অফিসে যদি এমন কোন কাজ এসে যায় যে আমাকে জরুরি কোন ডিজাইন বা ওয়েবসাইটের কোন কাজ করতে হবে, তখন আমি ঘরে বসেই কাজটা শেষ করে মেইল করে দিতে পারছি। এভাবে আমি বাসায়ও সাপোর্ট দিতে পারছি আবার আমার কাজটাও থেমে থাকছে না’।

উল্লেখ্য, সরকারের আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে ‘টেকসই নারী উন্নয়নে আইসিটি’ স্লোগানের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আইসিটি ডিভিশন মোবাইল আইসিটি ট্রেনিং ল্যাব চালু হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ২০১৭ সাল থেকে সাতটি বাসের মাধ্যমে দেশের ৬৪ জেলার ২ লাখ ৪০ হাজার তরুণী ও মেধাবী নারীর তথ্যপ্রযুক্তির মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রতিটি বাসে একসাথে ২৫ জনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে বাসগুলো নির্দিষ্ট রুটে চলাচল করছে এবং বছরে ৪০ সপ্তাহ কার্যক্রম চালাবে। অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা সম্বলিত ৫টি বাসের মাধ্যমে দুই দিনের ভ্রাম্যমাণ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চলমান রয়েছে বিভিন্ন জেলায়।

Share
এই পাতার আরো খবর –
পর্যটনে বাড়ছে নারীর আগ্রহ
জামাল উদ্দীন বাংলাদেশে নারীরা এখন একাই বেরিয়ে পড়তে চায়। পর্যটনের প্রতি তাদের আগ্রহ এখন বেশ বেড়েছে। কাজের ফাঁকে কখনো একা, কখনো…বিস্তারিত
সম্মাননা পেলেন সাংবাদিকরা
আমজাদ হোসেন সাংবাদিকতা একটা চ্যালেঞ্জিং পেশা। এ পেশায় নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। তারা বিভিন্ন বিষয়ে নিউজ কাভার করছেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কৃত হচ্ছেন।…বিস্তারিত
গণপরিবহনে কেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তারা?
গণপরিবহনে যাতায়াত করাটা নারীদের জন্য যে আর নিরাপদ নয়, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠনের পরিসংখ্যানেও বিষয়টি…বিস্তারিত
চালু হতে যাচ্ছে ‘জাস্টিস অডিট সিস্টেম’
মহিলা অঙ্গন প্রতিবেদক দেশজুড়ে শিশু নির্যাতন ও সহিংসতা প্রতিরোধে দ্রুতই চালু হতে যাচ্ছে ‘জাস্টিস অডিট সিস্টেম’। এর ফলে শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর…বিস্তারিত
লজ্জা ও অসচেতনতার কারণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
নারীর ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতা নিয়ে এখনও আমাদের সমাজে সেভাবে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। বিষয়টি নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে খোলামেলা আলোচনার মানসিকতা এখনও আমাদের সমাজে…বিস্তারিত
অবসরে আয়
সৈয়দা সেহরিন আহমদ ফরিদপুর থেকে এসে নগরীর একটি কলেজে পড়ছে তামান্না আফরিন। বাড়ি থেকে সে নিয়মিত টাকা পান। তারপর প্রতিমাসেই তার…বিস্তারিত
সর্বশেষ
সর্বাধিক পঠিত

প্রযুক্তির আঙিনায় ওদের পদচারণা
পর্যটনে বাড়ছে নারীর আগ্রহ
সম্মাননা পেলেন সাংবাদিকরা
গণপরিবহনে কেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তারা?
চালু হতে যাচ্ছে ‘জাস্টিস অডিট সিস্টেম’
লজ্জা ও অসচেতনতার কারণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
অবসরে আয়